ষষ্ঠ পর্ব
মুম্বাই থেকে গোয়া। আর গোয়ার সমুদ্র তীরে ছিপছিপে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ছন্দা। ছোট ছোট ঢেউ তার পায়ের উপর এসে আছড়ে পড়ছে। সেই ফটো তুলতে ব্যস্ত অলোক। দুজনেই অফিসের কাজের নাম করে ছুটি নিয়ে বোম্বে এসেছিল। সেখান থেকে তিন দিন হল তারা গোয়া এসেছে। কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরে আসবে। ফটো তোলা শেষ হলে দুজনে একটা গাছে গুড়ির উপর বসলো। নীল সমুদ্রের নীল জলরাশি যেমন এক অনাবিল সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে তেমনি তার ঢেউগুলি আছড়ে পড়ছে তাদের পায়ের তলায়। আর সাদা সাদা ফেনা গুলি মনে হচ্ছে শরতের আকাশে ভাসমান পেজা তুলোর মত মেঘ। গাছের গুড়ির উপর জমে উঠেছে তাদের প্রেমালাপ। দুঃখ যেন এদের চেনেই না। দুপুর থেকে সারা বিকেল এখানেই কেটে গেল আশেপাশে ঘুরে আর আরব সাগরের নীল জলরাশিতে পা ডুবিয়ে।
গোয়ার পথঘাট ভালো চেনে না তারা, তাই দুজনকে ফিরতে হল সন্ধ্যের অনেক আগে। বিরাট হোটেল। হোটেলের সামনে ফুল বাগান। সেখানে সন্ধের সময় বসে গল্প করা যায়। দোতালায় একটি ঘরে ওরা থাকে। এতদিনে দুজনের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। অলোকের সামনে বাধা তার পত্নী পারমিতা। কিন্তু ছন্দার কোন বাঁধাই নেই। না হলে এই ভাবে একজন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে থাকতে পারে। জানালা দিয়ে শুক্লা পক্ষের অষ্ট কলার চাঁদের আলো পড়েছে ঘরে, ছন্দা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক দূর থেকে সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে। হোটেলের পিছনে ছোট বড় নানা আকারের গাছ আছে। জানালার বাইরে ছন্দার ঠিক সামনে একটা মাঝারি আকৃতি ঝাউ গাছ। দুটি জ্যোস্না পোকা স্বাধীনভাবে মিটমিট করে ঘুরে চলেছে আর আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিধারা। অষ্টকলার চাঁদের আলোকে সেই জ্যোস্না পোকার আলো বেশ ভালোই লাগছিল। ছন্দা সেটা অলোককে ডেকে দেখায়। অলোক তখন ছন্দার হাত ধরে বলল - এরা কি আমাদের নতুন জীবনের পথ দেখালো ছন্দা?
ছন্দার মুখে কুটিল হাসি যেন কত রহস্য জড়ানো। তা বুঝবার শক্তি অলোকের মতো ব্যক্তির নেই। হাসিমুখে ছন্দা বলল - হয়তো তোমার কথাই ঠিক।
অলোক - আবার হয়তো কেন ছন্দা? বলো ইয়েস।
ছন্দা - আমি বুঝতে পারছি না ঠিক কি করে সম্ভব।
- সম্ভব নয় কেন ছন্দা?
- তোমার বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। তাদের ছেড়ে তুমি কি করে আমার কাছে আসবে?
- পারমিতার কথা ভাবছো? ওকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই। আমরা কলকাতায় থাকবো।
- তবে কি ওরা না খেয়ে মরবে?
- খুব দরদ দেখছি। আরে না ওরা না খেয়ে মরবে না। ওখানে আমার অনেক জায়গা জমি আছে, ও গুলোতে ভালো ফসল হয়। সারা বছর চলে যাবে অদের চিন্তা নেই।
- তাহলে তো বাধাই থাকলো না। এখন তুমি কতটা পারবে ওদের ছাড়তে সেটাই দেখার।
- চিন্তার কিছু নেই তুমি আজ বললে, আমি ছেড়ে দিলাম।
- তাই নাকি? তাহলে এমনি করে আমাকেও একদিন ছেড়ে দিতে পারো তো?
- ছিঃ ও কথা বলনা। তোমাকে ছাড়া আমি বাচবো না।
- তাই।
তারপর দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইল। চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছে সদ্য বিবাহিত দুই নব দম্পতি। ওরা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে বিশ্বে প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য উপভোগ করছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ওরা দুজন ফিরে আসে বিছানায়।
কুসুমপুর গ্রাম কিছুদিন হল চোর ডাকাতের ভয়ে আতঙ্কে ভুগছে। এখানকার মানুষের টাকা পয়সা সোনা-দানা সব লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে ডাকাতের দল। গ্রামে চোর ডাকাতের উপদ্রব মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। দর্মার বেড়া বা মাটির দেয়াল দেওয়া বাড়িগুলি দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ছে চোরদের দল। পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেউ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। মুখে নানারকম সব মুখোশ পরা। গায় সবার কালো জামা। রাতে কেন বাচ্চারা দিনের বেলাতেও ভয় পাবে তাদের দেখে। এক একদিন এক এক পাড়ায়। কখনো পাশের শহর তলিতে, আবার কখনো পাশের পাড়ায়। কোন দিন কোথায় হানা দেবে তার কিছু বলা যায় না। সন্ধ্যে হলেই সবার মনে ভয় ছড়িয়ে পড়ছে। চারিদিকে পুলিশ পাহারা। সন্ধ্যায় শুধু ঝিঝি পোকার ডাক ছাড়া কিছু শোনা যায় না। সব থেকে বেশি ভয় পারমিতারের। বড়বাড়ি অথচ ওদের বাড়িতে কোন বিপদ এখনো ঘটেনি। অন্ধকার যখন চারিদিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তখন হঠাৎই একটা পায়ের শব্দ শুনে ভয়ে আতঙ্কে মুছড়ে পড়ল পারমিতা। কপাল ভিজে উঠল ঘামে। কিন্তু সাহস সঞ্চয় করে জানালাটা অল্প খুলে দেখল, বাগানে গরু ঢুকেছে। কার গরু সন্ধ্যায় গোয়ালে না গিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে। তারই পায়ের শব্দ। শুকনো পাতার উপর পা পড়ার শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল কেউ মনে হয় হেঁটে যাচ্ছে। সে জানালাটা বন্ধ করে দিল। একটু হালকা হল শরীরটা। একবার ভাবল গরুটা তাড়িয়ে দিলেই ভালো হতো। বাগানের সব ফুল গাছগুলিকে খেয়ে সাবার করে দেবে। কিন্তু ভয়ে দরজা খোলার সাহস হলো না।
সেই রাতেই পাশের বাড়ির সব চুরি গেল। রাতে সিঁদ কেটে চোরেরা ঘরে ঢুকে সবকিছু নিয়ে গেছে। বাড়ির সবাই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু কেউ শব্দ করতে পারেনি। সবার মুখের সামনে ধরা ছিল ধারালো সব অস্ত্র। পাড়া শুদ্ধ লোকের মনে ভীষণ ভয় ধরে গেল। কেউ কেউ টাকা পয়সা সোনা-দানা যা ছিল সব মাটিতে পুতে রাখল। সেই সময় গ্রামে আতাই করা হত। কেউবা টাকা জমা দিয়ে আসলো ব্যাংকে। পারমিতা কি করবে বা কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছিল না। হঠাৎ দরজা কড়া নড়ে উঠল। পারমিতা দরজা খুলে দেখে পিয়ন চিঠি নিয়ে হাজির। গোয়া থেকে অলোকের পাঠানো জরুরী কালীন চিঠি। পিওন চিঠি দিয়ে চলে যাবার পর পারমিতা চিঠিটা খুলে পড়ল। অফিসের কাজে আরো একমাস থাকতে হবে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল তার। মুহূর্তের বন বন করে ঘুরে গেল মাথা । কিন্তু এখন তাকে মাথা ঠান্ডা করে এগোতে হবে। চারিদিকে বিপদ। পাড়ায় রোজ ডাকাতি হচ্ছে। পুলিশ কে ডাকাতি সময় খবর দিয়েও আনা যায় না। দাকাত চলে গেলে তাদের যত দাপট দেখা যায়। অপরদিকে অ্লোক বাড়ি না থাকাতে পারমিতার ভয় বেড়েছে বেশি। একা মেয়ে মানুষ। তার মধ্যে ছেলেটাও তো বেশি বড় নয়। পারমিতা ভাবল বাপের বাড়ি খবর পাঠিয়ে ভাইকে নিয়ে এলে ভালো হয়। এসব কিছু খবর জানিয়ে বাবার কাছে খবর পাঠাল সে। পারমিতার বাবা খবর শুনে ভেবে অস্থির। কিন্তু এই ফসল ওঠার মুখে তিনি তো আর যেতে পারবেন না। তিনি তখন ভাবলেন প্রীতিশ কে পাঠালে কেমন হয়? ঠিক সেই মুহূর্তে প্রীতিশ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরে। শশীকান্তের মুখ অন্ধকার থেকে প্রীতিশ জিজ্ঞাসা করল - কিছু হয়েছে নাকি বাবা? তোমাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।
শশীকান্ত তখন সব খুলে বলল।
প্রীতিশ বলল - আমার তো পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। তাহলে বাবা আমি চলে যাই দিদির বাড়ি।
শশীকান্ত উত্তর দেয় - তুই থাকতে পারবি তো?
প্রীতিশ - তোমায় চিন্তা করতে হবে না। আমি থাকতে পারবো।
শশিকান্ত - তাহলে তুই কাল সকালে চলে যা।
প্রীতিশ সম্মতি জানিয়ে কিছু মুখে দিয়ে ছুটে গেল নদীর পাড়ে। আজ ঊর্মির আসার কথা আছে। দুজনেরই পরীক্ষা শেষ। বাড়ি ফেরার সময় তারা ঠিক করেছে বিকেল বেলা নদীর পাড়ে দাঁড়াবে।প্রীতিশ গিয়ে দেখে ঊর্মি তার জন্য অপেক্ষা করছে। ঊর্মি কে দেখে খুব রাগী মনে হচ্ছে। চোখমুখ একেবারে লাল হয়ে গেছে। প্রীতিশ কিছু বলতে ভয় পেল। ঊর্মি কে খুব অভিমানী লাগছিল। হঠাৎই সে টিয়া পাখির মত তরতর করে বলতে শুরু করলো - আমি কি সারা ক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থাকবো? এতক্ষণ কি করছিলে?
প্রীতিশ - কেন বাড়ি যেতে, খেতে সময় লাগে না? তুমি কি না খেয়ে এসেছো?
ঊর্মি - না না খেয়ে আমি আসার মেয়ে আমি নই।
প্রীতিশ - বাহঃ রেগে গেলে তো তোমাকে খুব ভালো লাগে।
ঊর্মি উত্তর দেয় - ভালো লাগে না ছাই লাগে।
একটা ঘাস জমি দেখিয়ে প্রীতিশ ওখানে বসার জন্য বলে। হঠাৎই উর্মির রাগ কমে যায় বলে - চলো।
দুজনে সেখানে গিয়ে বসে। কিন্তু ঊর্মি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। তাই দেখে প্রীতিশ বলে - আজ কি হল বলতো? কথা বলছো না ?
ঊর্মি - কই কিছু নাতো। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়ালে তোমারও রাগ হতো।
প্রীতিশ - ও তাই বল দেরি হয়েছে তাই এত রাগ।
ঊর্মি - কাল আমরা আগ্রা বেড়াতে যাচ্ছি। বাবার কিছুদিন ছুটি আছে। এই সুযোগে যদি তাজমহল টা দেখে আসতে না পারি তাহলে আর কখনো যাওয়া হবে কিনা জানি না। এতদিন তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। তাই মনটা একটু খারাপ। তার মধ্যে তুমি এলে দেরি করে।
প্রীতিশ - ভালোই হলো, আমিও কাল দিদির বাড়ি যাচ্ছি। আমি ভাবছিলাম এই কদিন কি করে কাটাবে। দুজনের কেউ যখন কাছে থাকব না তখন আর চিন্তা কি? কিন্তু আমায় যে কতদিন থাকতে হবে জানি না।
কথা টা বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে।
ঊর্মি - কেন তোমাকে এতদিন থাকতে হবে কেন?
প্রীতিশ তখন তার দিদির বাড়ির কথা সবটাই বলে।
ঊর্মি - আমি অবশ্য ৮-১০ দিনের জন্য যাব। তবে তুমি একটা পথ অবলম্বন করতে পারো। মাঝে মাঝে বাড়িতে আসবে আর …………………
প্রীতিশ - আর তোমায় দেখে যাব তাই তো?
- না হলে আমি বাবা অতদিন তোমায় না দেখে থাকতে পারবো না।
- তুমি কি ভাবছো আমি তোমাকে না দেখে থাকতে পারবো?
- তুমি তাহলে আসছ তাই তো?
- অবশ্যই। আসতে তো হবেই।
- আচ্ছা থাক ওসব কথা। বলত তুমি আমায় কতটা ভালোবাসো ?
- ছেলে মানুষের মতো প্রশ্ন। ভালোবাসা কি পরিমাপ করা যায় নাকি? অন্তর দিয়ে অনুভব করতে হয়।
- না তবুও তো একটা…………………।।
- একটা কি দুটো জানিনা তবে এটা বলতে পারি আমি আমার সমস্ত হৃদয় উজার করে দিয়েছি শুধু তোমার জন্য। হয়তো এখনো তুমি তা বোঝনি।
- কি করে বোঝাবো আমিও ভালোবাসি।
শুধু চারিধার একবার ভালো করে দেখে নিল ঊর্মি। ফাঁকা জনহীন বিকেলে শুধু দুজন ছাড়া আর কেউ কোথাও নেই। ঊর্মি তার নরম হাত দিয়ে প্রীতিশের মুখ নিজের কাছে টেনে নিয়ে এল। তারপর চুমু খেলে দুই গালে। প্রীতিশ অ পাল্টা উর্মীকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এসে চুমু খেলে রাঙা ঠোটে।
এই প্রেমের ছোঁয়া দুজনের মনকে নিয়ে গেল এক অজানা অনুভূতির দেশে প্রীতিশের কোলে নিজেকে এলিয়ে দিতে ইচ্ছা করছিল ঊর্মির কিন্তু এটা মাঠ তাই সাহস হলো না। তবুও প্রীতিশ একেবারে কাছে টেনে নিল ঊর্মিকে। তার পর বলল - আমাদের এই ভালোবাসা সারা জীবন থাকবে তো?
উর্মি - কেন কেন থাকবে না?
প্রীতিশ - যদি না থাকে।
ঊর্মি - তোমার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবো আর তুমি?
প্রীতিশ উর্মির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দুজনের চোখ আটকে যায় চোখের মাঝে। সূর্য পশ্চিমে অস্তায়মান। লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে গাছের ফাঁক দিয়ে আবিরের মতন। গাছের পাতায় পাতায় যেন এক শিহরণ জাগানো রঙের উৎসব। প্রীতিশ বলল চল - বেলা শেষের পথে। আজ বাড়ি ফিরে যাই।
তারা দুজন নির্জন শান্ত পথ ধরে বাড়ি ফিরে আসে।
0 মন্তব্যসমূহ