পঞ্চম পর্ব
ঊর্মি ধনী পরিবারের মেয়ে, বাবার পয়সার কোন অভাব নেই. পরিবারের মধ্যে একটা আভিজাত্য আছে। কিন্তু তার কোন প্রভাব পড়েনি ঊর্মির উপর। গ্রামের শেষে যেখানে থেকে শহর শুরু হয়েছে সেখানে ঊর্মির বাড়ি। গ্রাম্য সভ্যতার ছোঁয়া শহরে পৌঁছায় সন্ধ্যেবেলা, যখন গ্রাম বাংলার মায়েরা বোনেরা শঙ্খের বা উলুধ্বনি করে তখন। আর বসন্তে যখন কোকিল ডাকেন তখন। এসব কিছু শহর আর গ্রামের মধ্যে এক মেলবন্ধন। ঊর্মি শহরের এক নাম ইস্কুল থেকে পাস করে কলেজে এসেছে। এই অঞ্চলে ঊর্মির বাবা সুজয় বাবুর একটা সুখ্যাতি আছে। যেকোন ভালো কাজে তার নাম শোনা যায়। পেশায় ইনি একজন নামকরা ব্যারিস্টার। তিনি হুগলি কোর্টে ব্যারিস্টারি করেন। গ্রামে আগে অনেক সম্পত্তি ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। সব বিক্রি করা হয়ে গেছে দেখাশোনা করার লোকের অভাবে। ঊর্মি সুজয় বাবুর একমাত্র মেয়ে। বড় আদরের মধ্যে লালিত পালিত। কোনদিন কোন অভাবের ছোঁয়া ঊর্মি কে স্পর্শ করতে পারেনি। যখন যা চেয়েছে তখন তাই পেয়েছে।অথচ অহংকার কি জিনিস তা তার মধ্যে নেই। সবার সঙ্গে সমানভাবে মেলামেশা করে। কে ধনী কে দরিদ্র তার বিচার করেনি কোনদিন। তাই প্রীতিশের সঙ্গে নির্দ্বিধায় মেলামেশা করতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। তারা তারা যেখানে পড়ে সেই গৃহ শিক্ষক প্রতিবারের মতো এবারও ঠিক করেছে দূরে কোথাও বোন ভোজনে যাবে। সবাই মিকে ঠিক করলো ব্যান্ডেল চার্চের যাওয়ার কথা। হুগলী জেলায় থেকেও হুগলীর এই পরম বিস্ময়টি এখনো দেখা হয়নি ঊর্মির। কলেজের অনেক বন্ধুবান্ধব এবং আরো অনেক ছেলেমেয়েরা যাবে। খুব আনন্দে আছে সবাই।
এত বড় হয়েছে ঠিকই কিন্তু ব্যান্ডেল চার্চ দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার আগে কোনদিন। তার মধ্যে আবার সঙ্গে থাকবে প্রীতিশ। কিন্তু যখন শুনল প্রীতিশ যাবে না তখন সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল। ঊর্মির মন খারাপ হয়ে গেল তাই বিকেল বেলায় মাঠে ছুটল। প্রীতিশের খেলা শেষ হলে ইশারায় ডেকে নির্জনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল - শুনলাম তুমি যাবে না?
প্রথমে প্রীতিশ কিছু বলতে চাইছিল না। কিন্তু পরে প্রেমিকার অভিমানে সব খুলে বলে।
প্রীতিশ - এখন আমার যাওয়া হবে না। কারণ বাড়ি থেকে টাকা পয়সা দেবে না। কারণ সামনে ফসল কাটার সময়। আর এ বছর ভালো ধান হয়নি। তাই খুব বুঝে ব্যয় করতে হবে।
ঊর্মি - টাকাটা যদি আমি দিই?
- তুমি?
- হ্যা, আমি?
- তুমি দেবে? কথায় পাবে?
-বাবা কে বলে ব্যাবস্থা করে নেব।
- তোমার বাবাকে কি বলবে?
- আমি দেবো বলেছি যখন দেব। কিভাবে দেব তোমার সেই চিন্তা করতে হবে না।
অন্যের পয়সায় যেতে পছন্দ করে না প্রীতিশ। তাই প্রথমে দারুন আপত্তি করেছিল। কিন্তু ঊর্মি যখন বলল - “তুমি না গেলে আমিও যাব না”।
তখন নিরুপায় হয়ে হ্যা বলতে হল। উর্মির আশায় জল ঢালতে চায় না সে। তাই রাজি হয়ে গেল। কিন্তু সত্যি ওর ইচ্ছা ছিল না।
প্রীতিশ বলল - কিন্তু কাউকে জানাবে না যে …………।
ঊর্মি - না না কেউ জানতে পারবে না। আমি টাকাটা তোমাকে দেব। তুমি স্যারকে দিও।
প্রীতিশ - সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো চলো তোমায় এগিয়ে দিয়ে আসি।
রাতে ঊর্মি বাবার কাছে বোন ভোজনের টাকা চাইল।
সুজয় বাবু - তোর বন্ধু সুমিতা বলল ২৫০ টাকা তুই চাইছিস ৫০০ টাকা কি করবি এত টাকা?
ঊর্মি - সুমি তো অনেক অনেক হাত খরচ নিয়ে যাচ্ছে।
সুজয় বাবু আর কোন কথা বলল না। পকেট থেকে দুটো ৫০০ টাকার নোট বার করে দিল। টাকাটা নিয়ে ঊর্মি সোজা চলে গেল পড়ার ঘরে। বইয়ের ভাজে ভালো করে টাকাটা গুছিয়ে রাখল। তারপর পড়া শুরু করলো। পড়তে পড়তে ঘুম পাচ্ছে ভীষন। তার মধ্যে বারবার প্রীতিশের কথা মনে পড়ছিল খুব। প্রীতিশ কে ভীষণ ভালোবাসে সে। চোখে মুখে একটু জল ছিটিয়ে আবার পড়তে বসেছ কিন্তু আজ ওর বারবার মনে পড়ছিল প্রীতিশের কথা। ঊর্মি জানে প্রীতিশের বাড়ির অবস্থা ভালো নয় তবুও তার উপর পূর্ণ আস্থা আছে। সে একদিন বড় হয়ে চাকরি করবে অথবা ব্যবসা করবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তারপর দুজনে……………………।
মা খেতে ডেকেছে অনেকবার। এবার না গেলে রক্ষা নেই। ঊর্মি খেতে চলে গেল। পরের দিন কলেজে গিয়ে ঊর্মি টাকাটা দিয়ে দেয় প্রীতিশ কে। কেউ জানতে পারলো না। জানতে পারলে আবার অনেকে খারাপ ভাববে এই একটা ভয় ছিল। সময় মতো দুজনেই টাকাটা জমা দেয় শিক্ষকের কাছে। কয়েক দিন পর এলো সেই দিন। সবাই প্রস্তুত। প্রীতিশ স্যারের খুব প্রিয়। স্যার তার উপর ভার দিয়েছে সব ঠিকমতো দেখাশোনা করার। একটা গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রয়োজনীয় মালপত্র তুলে সবাই চেপে বসলো। বন্ধুরা আগে থেকে প্রীতিশের জন্য একটা সিট ফাঁকা রেখেছিল। একেবারে ধারে বসবে ঊর্মি। ঠিকতার পাশে ডান দিকে প্রীতিশ। হইহই করতে করতে চলল সবাই। গাড়ির মধ্যে গান বাজনা হচ্ছে। কৌশানি দুটো ভালো গান গাইলো। আরো অনেকে গান করল। হইচই করতে করতে তারা পৌঁছে গেল সেই বিখ্যাত ব্যান্ডেল চার্চ। রবিবার ছুটির দিন। একটু ভিড় ছিল। কিন্তু তাতে ওদের কোন অসুবিধা হলো না। মেয়েরা সব তরিতরকারি কাটতে বসে গেলো এবং ছেলেরা রান্নার উপকরণ জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কারণ তাড়াতাড়ি রান্না খাওয়া শেষ করে ঘুরে দেখতে হনে চার্চ। দু একজন গান গাইছে আর তাতেই অন্যরা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটা নতুন আনন্দ আর অভিজ্ঞতা। কড়ার মাংস চাপানো হয়েছে। কিন্তু ঝোল দিতে দেরি আছে। একজন গরম কড়া থেকে এক টুকরো মাংস তুলে নিয়ে দিলে দৌড়। এতে তাকে অনেক কথা শুনতে হবে তাতে কি। তার কান্ড দেখে সবাই তো হেসে সারা। সবাইকে হাসানো টাই সঞ্জয়ের কাজ।
ইতিমধ্যে রান্না শেষ। ছেলে-মেয়েরা দল বেঁধে খেতে বসে পড়ল। খাওয়ানোর দায়িত্বে আছেন স্বয়ং স্যার প্রীতিশ আর রবিন। এরা তিনজন পরে খাবে। প্রদীপ ঋতুর পাশে বসে ছিল। ঋতু অন্যমনস্ক হওয়াতে সে চট করে এক টুকরো মাংস তুলে সঞ্জয় কে দেয়। যারা দেখতে পেল তারা তো হেসে সারা। ঋতু কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলে না। থালায় তাকিয়ে দেখে তার মাংস চুরি গেছে। এইরকম আরো অনেক ছোট বড় ঘটনা নিয়ে বেশ জমে উঠেছিল তাদের বনভোজন। , বনভোজনের এটাই আনন্দ। সবার খাওয়া শেষ। সকলে মিলে জিনিসপত্র পরিস্কার করে আবার গাড়িতে বোঝাই করতে করতে দুটো বেজে গেল। সবাই একসঙ্গে ঢুকলো চার্চ দেখতে। বাইরে থেকে ভীষণ ভালো লাগে। রৌদ্রের আলো দেওয়ালে পড়লে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। দেওয়ালের দিকে তাকানো যায় না। ভিতরে একটা সুদৃশ্য বস্তু দেখে তারা অবাক হয়ে যায়। সকলের অন্তরালে প্রীতিশ আর ঊর্মি চার্চের পবিত্র তাম্র ফলকে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করে - “আমরা দুজন দুজনকে প্রাণ ভরে ভালোবেসে যাবো। যদি কোনদিন ভুল বোঝাবুঝি হয় তাহলে আমারা নিজেরাই শুধরে নেব”।
অন্য সবাই যে যার মত ঘুরে বেরাচ্ছে। প্রীতিশ আর ঊর্মি এক ফাঁকে উপরে উঠে গল্প করছে। ভগবানের এক অপূর্ব সৃষ্টি প্রেম যার গল্পের কোন শেষ নেই। কোন না কোন গল্পে ঠিক মন মজে যাবেই। সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্দিষ্ট সময়ে সবাই ফিরে আসে তাদের গাড়ির কাছে। তারপর আবার হই হই করতে করতে মহা উল্লাসে ফেরে বাড়িতে। এটা ওদের সবারই নতুন একটা অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর হয়ে থাকলো। হাজারো অভিজ্ঞতার ভিড়ে এমন অনেক স্মৃতি হয়তো বা মনের গহন গহীনে প্রান্তে জায়গা করে নেবে।। কিছু স্মৃতি হারিয়ে যাবে আবার কিছু স্মৃতি চিরজীবনের জন্য মনের কোনায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। বাস চলছে তার আপন গতিতে আর ছেলে মেয়েরা সেই চলন্ত বাসের মধ্যে শেষ বেলার আনন্দটুকু লুটেপুটে নিচ্ছে প্রাণ ভরে।
0 মন্তব্যসমূহ