পর্ব ১৯
একদিন বিকেলে ইভা ছাদে বসে দূরের একটি খোলা জায়গায় ছোট ছোট বাচ্চাদের খেলা করা দেখে। ইভার স্বপ্ন ছিল ওর সন্তান এই ভাবে আর পাঁচটা বাচ্চার সঙ্গে মিলে মিশে হাসবে, খেলবে। ওকে মা বলে ডাকবে। ছুটে এসে উঠবে কোলে। না ইভার মা হওয়া হয়নি। আকাশে তখন অস্তায়মান সূর্য। সেই বিকেলে দেখল দু দুটো রিক্সা এসে দাঁড়ালো ওহিন দের বাড়ির কাছে। যে বাড়িতে এতদিন ভাড়াটেরা থাকত। ভাড়াটে রা দুদিন আগে উঠে গেছে। ইভা ভেবেছিল নতুন কোন ভাড়াটে হবে। কিন্তু বেশ ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো তৃষার দাদা এসে ঘরের দরজা খুলে দিল। আবার মাল নামিয়ে ঘরে তুলছে। পিছনের একটি রিক্সায় আছে একজোড়া দম্পতি। আর একটি ফুটফুটে বাচ্চা। ইভার মনে পড়ে গেল পাঁচ বছর আগের একটা কথা। এই ছাদে দাঁড়িয়েই তো তৃষা বলে গিয়েছিল অহিন কে সে ভালবাসবে। তাহলে সে যে শুনেছিল তৃষা অহিনকে বিয়ে করেছে। তাই সত্যি। ইভা কোন কিছু আর ভাবতে পারেনা। আস্তে আস্তে বসে পড়ে ছাদে। চারদিক তার কাছে অন্ধকার হয়ে আসছে। সে সবার কাছেই হেরে গেছে।
সত্যিই রিক্সা থেকে নেমে আসে অহিন আর তৃষা, সঙ্গে ওদের ছোট্ট মেয়ে। মেয়েটা মায়ের কোল থেকে নেমেই দৌড়াতে শুরু করে তার খেলনার ব্যাগটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ওর ছোট্ট ছোট্ট পায়ে জোড়া নূপুর সুর তুলে বেজে ওঠে। দুদিনের মধ্যেই তৃষা বাড়িটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে গুছিয়ে নেয়। অহিন তার পুরনো অফিসে আবার ফিরে এসেছে।
একদিন বিকেলে তৃষা তার ছোট্ট মেয়ে নুপুর কে নিয়ে ঘুরতে বের হয় পাড়ায়। তৃষা অবশ্য এসেই শুনেছে ইভার কথা। কেউ ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তৃষা ওর পুরনো দুই একজন বন্ধুর বাড়িতে যায়। মেয়ে হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাড়াটা ঘুরে দেখে। আর তখন তার মেয়ের পায়ের নুপূরের ঝমঝম শব্দ বেজে ওঠে চিকন সুরে । রাস্তাতেই দেখা হয় আসার সঙ্গে। আশা প্রথমে এগিয়ে এসে ছোট্ট নুপূরকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে বলে - কোথা থেকে কি হয়ে গেল বল? কেমন আছিস?
তৃষা একগাল হেসে বলে - ভালো আছি ন্রে। ভীষণ সুখে আছি। ভগবান যেন এই রকম সুখে রাখে। তারপর তোর কোথায় বিয়ে হল? কেমন আছিস তুই?
আশা - চল না আমাদের বাড়িতে। যেতে যেতেই কথা বলি।
আশার কোল থেকে ছোট্ট নুপূর আধো আধো স্বরে বলে - আমি না- ম - ব।
আশা আর এক প্রস্থ আদর করে, বারবার কয়েকটা চুম্বন করে নামিয়ে দেয় কোল থেকে। তৃষা ও আশার হাত ধরে এগিয়ে চলে নুপূর। যেতে যেতে আশা বলে - এদিককার খবর শুনেছিস?
তৃষা - তোর কথা বল।
আশা - আমার কথা আর কি বলব। দেড় বছর হল বিয়ে হয়েছে। এখন কদিন এখানে থাকবো।
তৃষা - সে না হয় তোকে দেখেই বুঝলাম। কিন্তু বিয়েটা হল কোথায়? তুই নাকি কার প্রেমে হাবু ডুবু খাচ্ছিলি।
আশা - ছাড় অসব কথা। আপাতত জেনে রাখ বিয়ে হয়েছে হালিশহর।
কি করে তোর বর ?
ব্যবসা করে।
বেঁচে গেছিস।
কথা বলতে বলতে আশাদের বাড়ি এসে হাজির হয় তৃষা। বাড়ির সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে তৃষার কথা শোনার জন্য। আশা কিন্তু ব্যস্ত নুপূরকে নিয়ে। ইস কি ফুটফুটে সুন্দর দেখতে। হাঁটলে দৌড়ালে পায়ের নুপুরগুলো যেন কথা বলে।
ইভা ছাদে দাঁড়িয়ে দেখল তৃষা আর তৃষার মেয়েকে। কি সুন্দর আশা আর তৃষার হাত ধরে হেঁটে চলেছে। আর ওর পায়ের নুপূরের চিকন শব্দ বোধয় ইভা কে বিদ্রুপ করছিল বারবার। ইভার পায়ের নুপূরে তো এমনি শব্দ করেই বাজতো। তাহলে কি অহিন আর তৃষার ইভাকে বিদ্রুপ করার জন্য ওদের মেয়ের পায়ের নুপূর পরিয়ে দিয়েছে। তা কেন সব ছোট বাচ্চাদের পায়ে তো নুপূর থাকে। ইভা বুঝতে পারে না তার মনের অবস্থা। ইভা ভেবে ছিল তৃষা একবারের জন্য হলেও ছাদের দিকে তাকাবে। কিন্তু না তৃষা একবারের জন্য তাকালো না। ইভা ছাদ থেকে নেমে আসতে চেয়েছিল। সেই সময় নুপুরের শব্দ একটু জোরে বেজে ওঠে।, ইভা দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কেমন করে দৌড়ে চলেছে তৃষার মেয়ে। সঙ্গে সমানতালে পায়ের নুপুর গুলো বেজে বেজে ওঠে ইভা কে যেন কিছু বলতে চাইছে।
পরাজিত ইভা ধীর পায়ে ছাদ থেকে নেমে এসে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ে। তখনও সন্ধ্যে অনেক বাকি। ইভার বারবার যেন মনে পড়ে ওর বিগত দিনের কথা। ওর পায়েও তো একদিন নুপুরগুলো সুর তুলে বেজেছে। যা কত কত প্রিয় ছিল অহিনের। সেই নু্পূরের শব্দ শুনে অনেক মেয়ের মধ্যে অহিন দা চোখে না দেখে বলতে পারত কোনটা ইভার পায়ের শব্দ। হয়তো সেদিনের কথা মনে করে তার মেয়ের পায়ে পরিয়ে দিয়েছে নুপূর। সত্যি কি তাই? নাকি আর পাঁচটা বাচ্ছার মতো মেয়ের পায়ে নুপূর দিয়েছে? না ইভা আর ভাবতে পারেনা। ইভা কেমন যেন দিশাহারা হয়ে পড়ে।
0 মন্তব্যসমূহ