হটাত ছন্দা এলো কেন? , পরাজিত প্রেম, পর্ব -১৬

 



উর্মি সবেমাত্র বাড়ি ঢুকেছে। ঠিক কিছুক্ষণ পরেই তার বাবা-মাও ফিরে এলো। সঙ্গে এসেছে বড় পিসির মেয়ে ছন্দা। সন্ধ্যা এখানে এলো অনেকদিন পর। আগে ছন্দা এলে উর্মির খুব আনন্দ হতো কারণ দুজনে মিলে বেশ বেড়াতে পারতো। এবার কিন্তু ঊর্মির কোন আনন্দ  হলো না বরং একটু অবাক হয়ে গেল। প্রীতিশের কাছে ছন্দার কথা  শুনে ওর খুব ঘৃণা করতে ইচ্ছা করছিল। উর্মি জানে এই ছন্দার জন্যই প্রীতিশ এর জামাইবাবু বিপথে গিয়ে চাকরি হারিয়েছিল। নিজেও একটু অবাক হয়ে গেল উর্মির ব্যবহারে। কারণ ছন্দা এলে উর্মি বেশ খুশি হত কিন্তু কি ব্যাপার এবার ওকে দেখে আনন্দ করছে না কেন? সন্ধ্যা ভাবল এখন অনেক বড় হয়ে গেছে হয়তো তাই একটু লজ্জা পাচ্ছে। সন্ধ্যা নিজেই এগিয়ে গেল উর্মির ঘরে। বলল - কিরে আমায় বুঝি চিনতে পারছিস না? 

উর্মি উত্তর দিল- তোমায় চিনব না।

 তারপর মিথ্যে করে বলে - আসলে আমার মাথাটা খুব যন্ত্রণা করছে তাই কিছু ভালো লাগছে না। 

ছন্দা -আয় দেখি আমি মাথাটা একটু টিপে দিই। 

ছন্দা কাছে এগিয়ে গেল নিজেই। 

উর্মি বলল তুমি দূর থেকে এলে তারপর এখনো পোশাক পাল্টাও নি তুমি বরং কাপড়-জামা ছেড়ে নাও আমি একটু শুয়ে থাকি। 

ছন্দা -বেশ তাহলে তুই শুয়ে পড় আমি কাপড় জামা ছেড়ে আসছি। 


ছন্দা চলে গেল বড় পিসি খুব গর্ব করে বলতেন উর্মিকে “তোর ছন্দা দিদি কত ভালো মেয়ে, ওকে দেখে জীবনটা গড়ে তুলিস। দেখবি বড় হতে পারবি”। উর্মি ভাবতে থাকে আর যদি ছন্দাদির কথা মত চলি তাহলে সমাজে আমার আর ঠাই হবে না। বলে নিজে নিজেই একটু হাসলো। যদিও সে বুঝতে পেরেছে ছন্দা দির এখানে আসার কারণ, আসলে ছন্দা হয়তো উর্মিকে বুঝিয়ে সুুঝিয়ে সন্তোষের ব্যাপারে রাজি করাতে পারে। এই কথা ভেবেই তার বাবা-মা তাকে নিয়ে এসেছে। উর্মি মনকে শক্ত করল। রাতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসলো। খেতে খেতে উর্মির মা নির্মলা দেবী উর্মির বিয়ের প্রসঙ্গ তুলল। 

নির্মলা দেবী বললেন - শোন তোর জন্য আমরা একটা ছেলে দেখেছি। ছেলেটা ভীষণ ভালো। বিরাট ব্যবসা। নতুন বাড়ি করেছে। আর তোর বাবারও খুব মত আছে। আর সেই জন্যই ছন্দাকে এখানে এনেছি যাতে ও একবার ছেলেটাকে দেখে যেতে পারে।

উর্মি কিছু বলল না কারন ও বুঝতে পারছে কোরমা কার কথা বলছে, তাই চুপ করে খেতে লাগলো। 

ছন্দা বলল ছেলেটার নাম কি মামিমা?

নির্মলা দেবী উত্তর দিলেন - সন্তোষ। চেহারা ভালো দেখতেও ভালো তার মধ্যে বিরাট ব্যবসা।

ছন্দা -তাহলে তুই আর অমত করিস না।

সুজয় বাবু এতক্ষন চুপ করে ছিল এবার বললেন - এখানে তো অমত করার কোন কারণ দেখছি না। 

নির্মলা দেবী - এখন তোর মতামতের উপর সবকিছু নির্ভর করছে। 

উর্মি মনকে শক্ত করে মুখ খোলে। বলে -নামা আমার এই বিয়েতে কোন মত নেই আমি কোনদিনই সন্তোষকে বিয়ে করতে পারবো না। স্কুল পালানো একটা ছেলের সঙ্গে আমাকে বিয়ে দেবে এটা তোমাদের কোন রুচির পরিচয়?

নির্মলা দেবী একটু বিরক্ত হয়ে বললেন -তবে কাকে করবে তোমার জন্য রাজপুত্র নিয়ে আসতে হবে নাকি? 

সুজয় বাবু - আহা উত্তেজিত হয়ে পড়ো না।

উর্মি -আমি কোন রাজপুত্র ও চাই না। 

সুজয় বাবু -তবে? 

ছন্দা - দেখুর মেয়ে তোর মা বাবা তোর ভালোর জন্যই এ কাজ করছে। তুই রাজি হবন। আমরা সবাই তোর ভালোই চাই। 

উর্মি - আমি ভীষণ দুঃখিত। আমি আমার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করব।

নির্মলা দেবী - উর্মি। 

সুজয় বাবু - তুই কার সামনে কথা বলছিস ভেবে দেখ। 

উর্মি - ভাবার কিছু নেই আমি আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলছি আর হ্যাঁ। কেউ বলছি আমি যাকে ভালোবাসি তাকেই বিয়ে করব। 

ছন্দা - ভালোবাসা তুই কি বুঝিস রে?

উর্মি চটপট উত্তর দেয় - আমি কিছু বুঝি আর না বুঝি আমার ভালোবাসার মধ্যে একটা পবিত্রতা আছে। লোভ নেই, লালসার নেই। আর তোমার মত কাউকে কষ্ট দিতে ও চাই না। আজ তোমার জন্যই তো একটা সংসার ভাঙতে চলেছিল। এই কি তোমার ভালোবাসার বোধ?


ছন্দার মুখ কালো হয়ে যায়, মাথা নামিয়ে নেয় সে।


নির্মলা দেবী রাগে চড় মারতে যাচ্ছিল সুজয় বাবু ধরে ফেলেন তাকে। 

সুজয় বাবু - ছোট মুখে বড় কথা মানায় না মা। আমরা তোর ভালোর কথা ভাবছি। 

উর্মি - তুমি কি আমার সুখ চাও না বাবা আমি প্রীতিশ কে ভালোবেসে ওকে বিয়ে করে সুখী হতে চাই আমি ওকে ভালোবাসি। 

নির্মলা দেবী বলেন -ওই কবি ছোকরাটা। 

উর্মি - শুধু কবি নয় সাহিত্য চর্চাও করে। 

নির্মলা দেবী -বুঝেছি লিখ হায় আর কত পয়সা? 

উর্মি - এইতো কদিন হলো স্কুলের চাকরি পেয়েছে।

সুজয় বাবু - ওর থেকে সন্তোষের অনেক পয়সা বড় ব্যবসা।

উর্মি - পয়সা থাকলেই সুখ আর শান্তি পাওয়া যায় না। একটা স্কুল পালানো ছেলের সঙ্গে আমি নিজেকে কোনদিনই বসাতে চাই না। ওর না আছে কোন রুচি না আছে কোন শিক্ষা দীক্ষা।

সুজয় বাবু -কিন্তু উর্মি তুই যদি জানিস আমি যে কথা দিই তার কোন হেরফের হয় না। আমি সন্তোষ কে কথা দিয়েছি তোকে বিয়ে করতেই হবে এই বলে দিলুম। 

উর্মি -আমার জীবন থাকতে হয়তো সম্ভব নয় বাবা। 

নির্মলা দেব -দেখো তোমার গুণধর মেয়েকে দেখো।


উর্মি খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল উর্মি চলে গেলে সুজয় বাবু ছান্দা কে বলে তুই কিছু মনে করিস না ও রাগের মাথায় বলে ফেলেছে। 

ছন্দা - না না মামা আমি ওসব নিয়ে ভাবি না। ও ছেলে মানুষ। 

সুজয় বাবু- শোনো নির্মলা, কাল থেকে উর্মিকে কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে যেতে দেবে না।

নির্মলা দেবী -বেশ তাই হবে ওকে জব্দ করতে গেলে তাই করতে হবে। 


এর মধ্যে সবার খাওয়া শেষ। রাতে সবাই শুয়ে পড়ল। উর্মির কিন্তু চোখে ঘুম নেই। কারণ বাবার শেষ কথাটা ও লুকিয়ে শুনেছে, ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে একা হঠাৎ মনে পড়লো তার বাড়ির বাগানের মালিক দেবু কাকার কথা। দেবু কাকার বয়স প্রায় ষাট হবে। এই চার পাঁচ মাস হলো দেবকাকে তাদের বাগানের কাজে নিয়োগ করা হয়েছে। দেবু কাকা ঊর্মিকে মেয়ের মতো ভালোবাসে এই কদিন আগে বাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে প্রীতিশের সঙ্গে কথা বলার সময় দেখে ফেলেছিল। কিন্তু দেবু কাকা বাড়ির কাউকে জানাইনি বরণ বলেছে এইতো বয়স দেব কাকাকে সকালে সব খুলে বলবে তাহলে দেবু কাকা প্রীতিশের সব খবর এনে দিতে পারবে। এইসব ভাবতে ভাবতে একটু শান্ত হলো মন তারপর “নয়ন তারা” কবিতার ‘নীলনয়না’ কবিতাটি পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

পরদিন সকাল হলে উর্মি আগে গেল বাগানে। দেবু কাকা তখন ফুল গাছে জল দিচ্ছে। দেবু কাকা ঊর্মিকে দেখে একটু আশ্চর্য হয়ে গেল। কোনদিন সকালে তো এখানে আসে না উর্মি। তাই দেবু কাকা তাকে জিজ্ঞাসা করল -কি ব্যাপার আজ সকাল সকাল ফুল বাগানে? 

উর্মি -বিপদে পড়ে এসেছি কাকা। 

দেবু -সেকি কি! হলো আবার তোমার? 

উর্মি -আগে বলো তুমি আমায় সাহায্য করবে? 

দেবু উর্মীর কথাই খানিকটা অবাক হয়ে গিয়ে বললেন -বেশ সাহায্য করতে পারি কিন্তু কি করতে হবে বলোতো মা? 

উর্মি - অনেক অনেক কিছু করতে হবে শুধু তুমি বলো কাকা আমায় সাহায্য করবে। 

দেবু - আচ্ছা আচ্ছা করব। আগে বলতো কি হয়েছে।

উর্মি প্রত্যেকটা ঘটনার আগাগোড়া বিবরণ দিয়ে দেবু কাকাকে সব খুলে বলল। আরিও বলল পৃথ্বীশকে ছাড়া ও অন্য কাউকে দিয়ে করতে পারবে না আর যদি করতেই হয় তবে তা মৃত অবস্থায়। 

উর্মির কথাগুলো শুনে দেবো কাকা খুবই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে চুপ করে তারপর আবার ঊর্মির কথায় সম্বিত ফিরে এল।

উর্মি বলল -কি কাকা তুমি পারবে তো সাহায্য করতে? 

দেবু -তুমি তো আমার কাছে এসেছো এখন ফিরিয়ে দি কি করে, এই বৃদ্ধ বয়সে যা পারা যায় তাই করবো মা। 

উর্মি -তুমি আমার চিঠি বা আমার খবর পৌঁছে দেবে ওর কাছে আর ওর খবর নিয়ে আসবে আমার কাছে এইমাত্র কটা দিন দেখো বাবা মা যেন জানতে না পারে কেমন। 

কথাগুলো বলেই উর্মি ফিরে এলো ঘরে, চোখে মুখে একটু আনন্দ ফুটে উঠলো। সকালে সবার সঙ্গে বেশ হেসে কথা বলছিল সে। তার মা নির্মলা দেবী তো একটু অবাক হয়ে গেল মেয়ের এমন আচরণে। তিনি মনে মনে ভাবলেন বোধহয় উর্মি রাজি হয়েছে রাতে হয়তো ভেবেছে তার বাবা-মায়ের কথা। নির্মলা দুটি তাড়াতাড়ি সুজয় বাবু কে খবরটা দিয়ে এলো। সুজয় বাবু মেয়ের আনন্দ দেখে খুশি হল। 

দুপুরের খাওয়া শেষ করে যে যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। ছন্দা মামিমার ঘরে বসে সিনেমা দেখছিল। উপরের ঘরে শুধু উর্মি শুয়ে আছে একা। তার চোখের কোনা দিয়ে ধীরে ধীরে জল বিন্দু নেমে আসছে। জল বিন্দুগুলি সুন্দর মুখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে নিচে। কখনো কখনো ওড়না দিয়ে মুছে নিচ্ছে। পরক্ষণেই আবার কিছু একটা মনে করে আবার গাল বেয়ে জল ঝরে চলেছে। উর্মির ডায়েরির ভাজে ভাজে প্রীতিশের ছবি। সেখান থেকে একটা বার করে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল বাইরে সূর্যের এক ফালি কিরণ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে ফটোটার উপর পড়েছে। এখন আরো সুন্দর লাগছে মুখটা। ফটোটা বুকের মধ্যে নিয়ে ভাবতে লাগলো উর্মি -আমার মন, আমার প্রাণ, আমার হৃদয়, আমার যৌবন আমি তোমাকে বিলিয়ে দিয়েছি। আমার যা কিছু তা সবই তোমার জন্য আমি অর্থ চাই না সম্পদ চাই না। আমি চাই শুধু তোমাকে। তুমি একদিন বলেছিলে আমি নাকি পদ্মের মত সুন্দর আমি যদি পদ্ম হই তবে তুমি আমার প্রাণ সূর্য। সেই কবে একদিন গির্জায় দুজনে প্রার্থনা করতে গিয়ে বলেছিলাম আমরা দুজন দুজনার। তোমার মনে থাকবে হয়তো কি জানি আমার তো মনে আছে। বিড়বিড় করে কথাগুলো একা একা বলতে থাকে উর্মি। 

তারপর হঠাৎ সে নেমে আসে নিচে দেবো কাকার সঙ্গে দেখা করার জন্য। ইচ্ছা ছিল বাগানে গিয়ে দেবো কাকার সঙ্গে দেখা করা কিন্তু সদর দরজা বন্ধ। চাইলেই খুলতে পারত কিন্তু তালা দিয়ে রেখেছে নির্মলা দেবী। তাই রান্নাঘরে জানালা দিয়ে দেবু কাকাকে ডাকতে লাগলো। 

উর্মি খুব সতর্ক হয়ে ডাকল -দেবু কাকা ও দেবু কাকা। 

দেবু বাবু ডাক শুনে বেরিয়ে এলো। বলল - তুমি এই দুপুরে ঘুমাওনি? 

উর্মি ফিসফিস করে বলে -ঘুম আসছে না। তুমি বিকেলে একবার ওকে বলে এসো আমার বাইরে যেতে মানা আছে। আর জোর করে আমাকে সন্ত্রাসের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করেছে। ও যেন কোন ব্যবস্থা করে তাড়াতাড়ি তুমি যেও কিন্তু কাকা। 

দেবু বাবু - তোমার চিন্তা করতে হবে না আমি ঠিক যাবো।

উর্মি নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে যায় ঘরে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ