অলৌকিক রাতের রহস্য

 




আমার জীবন শরতের আকাশে ভাসমান এক খন্ড সাদা মেঘের মতো। কৈশোর বয়স থেকে জীবন নদের খেয়া বাইতে বাইতে কখন যে সমুদ্রে এসে পড়েছে তা বুঝতে পারিনি। আমি এক ভবঘুরে। আমার জীবন চলমান মেঘের মতো ভাসমান। প্রিয় কবি জীবনানন্দের মত আমিও বাংলা রূপে দিশাহারা। কিন্তু কবির মত আমি বাংলায় আবদ্ধ নই। যখন যেখানে মন চেয়েছে তখন সেখানে ছুটে গিয়েছি। অপরূপ বাংলাকে যেমন দেখেছি, সবুজ ঘেরা পাহাড় দেখেছি, আবার দেখেছি ফেনিল জলরাশি উচ্ছে পড়া সমুদ্র বক্ষ। যেখানকার সৌন্দর্য আমাকে মোহিত করেছে সেখানে রাত কাটিয়েছি। কারণ দিনের থেকে রাতের সৌন্দর্য আমাকে বেশি করে টানে। পাহাড় ঘেরা এই ধরমশালার একটা হোটেলে রয়েছে আমি। তারই জানালার ধারে বসে নীল আকাশের বুকে তারাদের দেখছিলাম। পাহাড়ের কোলে অজস্র বাড়ি। আকাশে যেমন তারারা জ্বলজ্বল করছে তেমনি নিচের দিকে তাকালে বাড়ি গুলিতে জ্বলা আলো গুলো দেখে মনে হয় হাজার হাজার তারারা নিচেও জ্বলজ্বল করছে। আমার জানালার অনুতি দূরে অরণ্য নেমেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। আমার সঙ্গে এক পরিব্রাজক ছিলেন। তার সঙ্গে তীর্থ দর্শনই বেরিয়েছি। দুজনেই বৌদ্ধ কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে কোন ছুত মার্গ নেই আমার। আমার কাছে ধর্ম হল সৌন্দর্য আর পবিত্রতার মিশ্রণ। যখন সত্য আর ন্যায়ের পথ দেখায় তখনই ধর্ম সার্থক হয়। আমার সঙ্গী পরিব্রাজক ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার দেরি করে ঘুমানো অভ্যাস। তাই জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছিলাম। আমরা যে হোটেলটায় আছি, সেটা লোকালয় থেকে একটু দূরে নির্জন এলাকায়। এখানে একটি বৌদ্ধমট আছে। খুব কম লোকই এখানে মঠ দেখতে আসে। আমি নির্জনতা পছন্দ করি তাই এখানে এসে উঠেছি। সেদিন অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। সুন্দরী নারীর ঘন কালো চুলের মতো অন্ধকার ঘিরে রয়েছে চারিধার। বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে শরীরে কাঁপন ধরে যাচ্ছে সেই ঠান্ডা বাতাসে। তবুও মায়াবী রাতটা দেখার অদম্য ইচ্ছায় জানালাটা বন্ধ করলাম না। জানালার পাশে একটা বড় ঝাউ গাছ। তার পাশ দিয়ে শুরু হয়েছে হালকা জঙ্গল। যা ক্রমে দূরে গভীর জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। এখানে জন্তু-জানোয়ারের ভয়ও রয়েছে। অনেকক্ষণ পর যখন জানালাটা বন্ধ করতে যাব ঠিক তখনই চোখে পড়ল সাদা কাপড় পরা একটি নারী ঝাউ গাছের নিচ দিয়ে উপরের দিকে উঠছে। একটু অবাক হলাম। কৌতুহল বসতো জানালা থেকে একটু আড়ালে গিয়ে দেখতে লাগলাম তাকে। এই হিমশীতল অমাবস্যার অন্ধকার রাতে একা এক নারী নির্জন অন্ধকার ভেদ করে কোথায় চলেছে? জানার এক অদম্য ইচ্ছা চেপে বসলো মনে। খোলা জানালার প্রায় পাশ দিয়ে সেই রমণী হেঁটে গেল। একটা হালকা উষ্ণ বাতাস মুহূর্তে ঘরে এসে প্রবেশ করলো। আমি ভয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। পরিব্রাজক বন্ধু তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি ওর পাশে শুয়ে পড়লাম। নানা কথা মনে পড়ছিল শুয়ে শুয়ে। আসলে আমিও যে পরিব্রাজকের মতনই জীবন যাপন করি আজ এখানে তো কাল ওখানে প্রকৃতির সৌন্দর্যের টানে বারবার ছুটে গিয়েছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এতকিছুর মধ্যেও ওই নারী-মৃত্যুর কথা যেন কিছুতে ভুলতে পারছিনা। এত কাছ থেকে দেখলাম অথচ এই অন্ধকারে কিভাবে যে পথ খুঁজে হেঁটে চলেছে বুঝতে পারলাম না। অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। 

সকালে হোটেলের বাইরে চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে দিয়ে ঘুম ভাঙলো। পাশে দেখি আমার সেই পরিব্রাজক বন্ধু নেই। ওর আবার খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস। ভাবলাম হয়তো প্রাত ভ্রমণে বেরিয়েছে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। জামা কাপড় পরতে কিছুটা দেরি হলো বটে। তখনো কৌতুহলী চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে হোটেলের নিচে। আমি ধীর পদব্রজে নিচে নেমে এলাম। দেখলাম সাত সকাল হলেও সেখানে বেশ লোকজনের ভিড়। উৎসুক জনতা ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা জায়গা। তার ভিতর থেকে একটু উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। অনেক কষ্টে যখন উঁকি মারলাম তখন দেখলাম আমার সেই বন্ধুটি পড়ে রয়েছে মাটিতে। হঠাৎ মাথাটা গেল ঘুরে। কি ব্যাপার কি হল। যেন তার ভিড় ঠেলে পৌঁছে গেলাম সেই পরিব্রাজক বন্ধুর কাছে। চোখ দুটো খোলা বড় বড় শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। মুখ দিয়ে কোন কথা বার হচ্ছে না শুধু একটা ভয়ার্ত গোঙানির শব্দ। আমি কাছে যেতেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। আমি ওর নাম ধরে ডাকলাম কয়েকবার। একটু একটু সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছিল। এতটাই ভীত হয়ে পড়েছে এবং ভয়ে তার যে অবস্থা হয়েছে সেই ট্রমা থেকে তাকে বের করে আনতে হবে। ইশারা করে একজনকে জল আনতে বললাম। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকদিন ছুটে গিয়ে দু তিন বোতল জল এনে দিল। সেই জলের বোতল থেকে জল নিয়ে পরিব্রাজক বন্ধুর মুখে ছিটিয়ে দিতে কিছুটা যেন সম্বিত ফিরে পেল সে। এরপর তার মুখে ঘাড়ে কিছুটা ঠান্ডা জল ছিটিয়ে দিলাম। সেই বরফ শীতল জল তার ইন্দ্রিয়গুলিকে মনে হয় দ্রুত সঞ্চালিত করতে সাহায্য করেছিল। অন্তত আমার তাই মনে হল। সে আমাকে কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু তার অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ ছাড়া আর কিছুই আমার বোধগম্য হলো না। আরো কিছুটা শীতল জল মুখে এবং ঘাড়ে ছিটিয়ে দিতে একটু স্বাভাবিক হলো। উপস্থিত লোকেদের সাহায্য নিয়ে ধরাধরি করে ওকে নিয়ে এলাম হোটেলের ঘরে। তারপর একটু একটু করে সে স্বাভাবিক হতে লাগলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম -কি ব্যাপার বন্ধু কি হয়েছে? 

সে উত্তর দিল -খুব ভোরে আমি বেরিয়েছিলাম প্রাতভ্রমণে কিন্তু হঠাৎ পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরতে আসছিল সাদা কাপড় পরিহিতা এক মহিলা। ঘটনার সেই আপেক্ষিকতায় আমি কিছুটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। ঠান্ডা সুশীতল হাত জোড় দুটো গায়ে পরতেই কেমন যেন অজ্ঞান হয়ে গেলাম। রাস্তার ধারে পড়েছিলাম। মনে হয় ওই লোকগুলো তুলে নিয়ে এসেছে হোটেলের সামনে। হঠাৎ যে কি হল ঠিক বুঝতে পারলাম না। 

আমি বললাম -সাদা কাপড় উপর পরিহিত সেই ব্যক্তি নিশ্চয়ই কোন মহিলা ছিল। খুব রোগা তাইনা। 

সে বলল -অনেকটা তাই তবে আমি খুব একটা ভালো করেই যে দেখেছি তা নয়। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?

আমি বললাম -কাল রাতে তুমি যখন শুয়েছিলে আমি অনেকক্ষণ ঘরের ওই জানালা দিয়ে বাইরের অপরূপ দৃশ্য দেখছিলাম। গভীর রাতে হোটেলের পাশ দিয়ে হেটে যেতে দেখেছিলাম এক সাদা কাপড় পরিহিতা রমণীকে। অমাবস্যার ঘন অন্ধকার ভেদ করে হেঁটে চলেছেন একা। 

আমার বন্ধু বলল -সে কি তুমি দেখেছিলে তাকে। কিন্তু আমাকে তো কিছু বলনি। 

আমি উত্তর দিলাম- বলবো কি করে? তুমি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলে তাই শুধু শুধু তোমাকে ডাকার প্রয়োজন মনে করিনি। 

আমার সেই পরিব্রাজক বন্ধু বললেন - এ হোটেলে থাকা আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না বুঝলে ভাইয়া।

আমি বললাম-ব্যাপারটা যখন ঘটেছে তখন এর শেষ না দেখে তো যাওয়া যায় না। 

বন্ধুটি বলল -চলো শেষ দেখেই ছাড়বো তুমি যখন আছো সঙ্গে তখন আর ভয় করিনে। 

চলবে.....


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ