দু'টি আলাদা পথ, অধ্যায় ২। উপন্যাস: অপেক্ষা
কলকাতা শহর।
ব্যস্ততা, কোলাহল আর অচেনা মুখের ভিড়ে অভিরূপ যেন নিজের সত্তাটাকেই হারিয়ে ফেলেছিল। প্রথম কয়েক মাস রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আর ফুটপাথে কাটিয়েছিল। কাজ পেতে পেতে বহুবার ঠকেছে, অপমানিত হয়েছে, কখনও না খেয়ে থেকেছে পুরো দিন।
ক,ইন্তু রাত হলে ওর মনে পড়ে যেত রাধার কথা তাই একটা চিঠি রোজ লিখত রাধার উদ্দেশে।তার পর সেটা সকাল হলে ফেলে দিত ডাক বাক্সে। আর ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস সেই চিঠিগুলো পৌঁছাত না রাধার কাছে। নন্দীগ্রামে পোস্ট অফিসের নতুন পোস্টমাস্টার বুঝত না সম্পর্কের গভীরতা। ময়লা খামে লেখা চিঠি গুল পড়ে থাক্ত এক কোনায়। সে ঠাট্টা করে বলত - চিঠি আবার কে লেখে আজকাল! এই যুগে আমার চিঠি।
অভিরূপ জানত না তার চিঠিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আবার রাধাও জানত না যে অভিরূপ সত্যিই কথা রেখেছিল। সে নিয়মিত চিঠি লিখেছিল সে কথা রাধা জানতে পারলো না।
রাধার দিন কাটত প্রতীক্ষায়। সকালে গরুদের খাওয়ানো, মাঠে মা’র সঙ্গে কাজ, বিকেলে নদীর পাড়ে বসা। নদীর পাড়ে বসে অভিরূপের বলা সেই কথাগুলো মনে মনে ভাবতো সে। এই ভাবে দিন যায়, মাস যায়। বছর ঘুরে গেল পার তিনটি।
গ্রামের লোকেরা নানান কথা বলত। “ছেলেটা তো ফিরল না রে রাধা! ভুলে যা ওকে। কাউ কে করে বিয়ে কর।”
রাধা শুধু মৃদু হেসে বলত - সে ফিরবে। আমি জানি।
একদিন সে নিজেই এক চিঠি লিখল, তুমি ভালো আছ তো? আমি প্রতিদিন তোমার পথ চেয়ে থাকি। জানো, তোমার দেওয়া চুড়িগুলো এখনো পরে থাকি।
কিন্তু সেই চিঠিও পৌঁছাল না। কি করে পৌঁছাবে সেখানে তো ঠিকানা লেখা থাকতো না। অভিরূপের নামে ডাক বাক্সে ফেলে দিত সে চিঠি।
অবশেষে অভিরূপ নানান ঘাত প্রতি ঘাতের মধ্যে দিয়ে একটি সংবাদপত্রে চাকরি পেয়ে গেল রিপোর্টার হিসেবে। গ্রাম থেকে শহর নানা বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করত। এই ভাবে সে ধীরে ধীরে স্বপ্নের দিকে এগোতে থাকল ।
সারা দিনের কর্ম ক্লান্ত দেহটা যখন বিছানায় পড়তো তখন কিন্তু রাধার কথাটাই আগে মনে পড়তো। তবে মনের ভিতরে অনুশোচনা নিয়ে ভাবতে থাকে —কেন রাধা একটাও চিঠির জবাব দিল না? সে কি ভুলে গেল আমাকে?”
এই প্রশ্নই জ্বালাত তার রাতগুলো। দিন চলল, মাস কেটে গেল।
রাধা আর অভিরূপ—দুজনেই একে অপরের জন্য অপেক্ষায়, অথচ চুপচাপ দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে সেই ভাগ্যের ইশারায়। কারণ অভি কিছুতেই ছুটি করছে না। ওর যেদিন ছুটি থাকে সেই দিন গুলো ও প্রতিবেদন লেখা আর প্রতিবেদন তৈরি করা শেখে। তার জন্য আলাদা ক্লাস করতে হয়। মনে মনে ভাবে - একটু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সে রাধার বাবার কাছে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। কিন্তু দুরত্ব থিক বেড়ে চলেছে তার আপন নিয়মে।
0 মন্তব্যসমূহ