অপরাজেয় প্রেম- ১১

 একাদশ  পর্ব 






হঠাৎ দিদির জরুরী সংবাদ পেয়ে কুসুমপুর চলে এলো প্রীতিশ।  দিদির শরীর খুব ভেঙ্গে পড়েছে স্বাভাবিকভাবে।  দীর্ঘ পাঁচ বছর কেটে গেছে একা সামলাতে হয়েছে তার সমস্ত সংসার, মাঠ-ঘাট, জমি জায়গা সব। পারমিতা দুপুরে খাবার  পর ভাইকে ডেকে বলল -  জানিস ভাই,  কাল সেই সমরবাবু আবার এসেছিল।  

প্রীতিশ -  কি বললেন তিনি ? 

পারমিতা-  যা বলল শুনে আমার বুক পুড়ে যাচ্ছে রে ভাই।  ও নাকি রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়ায়। 

প্রীতিশ কে অলোক দাদা বাবু? 

অবাক হয়ে  জিজ্ঞাসা করল সে। 

পারমিতা - হ্যাঁ 

প্রীতিশ - কেন সেই মেয়েটার বাড়ি কি হলো?  

পারমিতা- সে  নাকি বিখ্যাত এক  ব্যবসায়ী কে বিয়ে করে চলে গেছে।  তারপর থেকে ওর ওই অবস্থা।  মদ খায় রাস্তায় রাত কাটায়। এখানে ওখানে যায় চাকরিটাও গেছে নাকি। 

কথাগুলো বলতে বলতে পারমিতার দুচোখ বেয়ে জল নেমে এলো। গলা ধরে গেল কান্নায়।  তারপর বলল -  তুই একবার যাবি ভাই? ওকে বাড়ি নিয়ে আয়। না হলে হয়তো পথেই শেষ হয়ে যাবে।  

প্রীতিশ - চাকরি নেই তো মদের পয়সা কোথায় পায়?  

পারমিতা কোন উত্তর দেয় না।  এর আগে প্রীতিশ কয়েকবার গেছে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু পারেনি। তখন অবশ্য ছন্দা ছিল ওর চাকরিও ছিল। 

প্রীতিশ -  সে না হয় গেলাম।  কিন্তু কোথায় আছে তা কে জানে?  

পারমিতা বলে -  লেক গার্ডেন্সের আশেপাশেই থাকে।  সমরবাবু তো তাই বলল।  উনি কোন কোনদিন জোর করে বাড়ি নিয়ে যান। কিন্তু রাতে আবার পালিয়ে আসে রাস্তায়।  


পরের দিন সকালে কলকাতায় পথে রওনা দিল প্রীতিশ।  খুব সকালে বেরিয়েছে হাওড়া স্টেশনে নেমে বাস ধরে সোজা লেক গার্ডেন্স।  অফিসের আশেপাশে চারিদিক প্রখর দৃষ্টি রেখে খুঁজে চলল সে। কিন্তু পেল না। কিন্তু ভাগ্যক্রমে দেখা হল সমর বাবুর সঙ্গে।  সমর বাবুকে দেখে প্রীতিশ ডাকল -  ও সমর দা,  সমরদা।  

সমরবাবু দাঁড়িয়ে পড়ে দেখলেন কে।  তারপরে বললেন - আরে তুমি?  

প্রীতিশ - হ্যাঁ আমি। 

সমর -  তোমার নামটা…………… 

প্রীতিশ চটপট উত্তর দেয়  - আমার নাম প্রীতিশ। 

সমর -  কি অলকের খুঁজে তো?  

প্রীতিশ - হ্যা।  

সমর - ময়দান চেনো?  

প্রীতিশ - নাম শুনেছি, চিনি না।  

সমর -  ও ওই ময়দানের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়।  

প্রীতিশ - সে আবার কবে থেকে?  

সমর -  এই দু তিন দিন হল,  এখান থেকে ওখানে গেছে। ওখানে ছন্দা থাকে।  

প্রীতিশ - আমাকে ময়দানে যাবার রাস্তা বলুন।  যে করেই হোক দাদাবাবুকে খুঁজে বার করতেই হবে।  

সমর - আমি তোমায় বাসে তুলে। ধর্মতলায় নেমে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে পাচিলে ঘেরা বড় মাঠে ঢুকে পড়বে।  দেখবে তিনটি বড় ঘেরা মাঠ আছে। ওর আশেপাশে গাছ তলায় ওকে ঠিক পাবে। আমি খেলা দেখতে গিয়ে ওকে কাল দেখে এসেছি।  

প্রীতিশ - অনেক অনেক ধন্যবাদ সমরদা।  

সমরবাবু প্রীতিশকে কে ধর্মতলাগামী একটা বাসে তুলে দিল।  


ধর্মতলা নেমে একজন ভদ্রলোকের কাছে জিজ্ঞাসা করে বিরাট বড় ঘেরা মাঠে প্রবেশ করল।  প্রথমেই একটি ঘেরা মাঠ চোখে পড়ল চারিদিকে কালো সাদা রঙে রঙিন।  গেটের উপর বড় বড় করে লেখা আছে “মহামেডান ক্লাব”। এখানে না পেয়ে আরেকটু এগিয়ে গেল আরেকটি ঘেরা মাঠ।  লাল হলুদ দেখেই বুঝতে পারল “ইস্টবেঙ্গল ক্লাব”।  এইসব ক্লাব আর মাঠ দেখে ফুটবল খেলার কথা মনে পড়ে গেল। এখনো সে খেলা ভালোবাসে। খেলা দেখে।  কিন্তু এখানে কোনো খোঁজ পেলো না। আরো কিছুটা হেঁটে আরেকটি বড় মাঠ। দিকে এগিয়ে গেল  সেই দিকে। সবুজ মেরুন রঙ।  মোহনবাগান। ছোটবেলা থেকেই প্রীতিশ মোহনবাগানের ভক্ত। একটু এগতেই দেখলো গেটের কাছে একটা লোক বসে  আছে। ঠিক অলকের মতো। মনের সন্দেহ হওয়াতে এগিয়ে গেল।  কাছে গিয়ে দেখল তার অনুমান ঠিক।  অলক দাদা বাবু।  কিন্তু একি নোংরা জামা কাপড়,  মাথার চুল ধুলো ময়লা জমে পাখির বাসার মতো হয়ে গেছে । কাছে এগিয়ে গেল প্রীতিশ।  অলক প্রীতিশ কে দেখে মাথা নত করে বসে রইল।  

প্রীতিশ বলল - একি অবস্থা তোমার দাদা বাবু।  চলো বাড়ি চলো।  

অলক - কে তুমি?  (না চেনার ভান করে।) 

প্রীতিশ - আমি প্রীতিশ।

অলক - আমি তো এই নামে কাউকে চিনি না।  

প্রীতিশ - ছলনা করো না।  (একটু কঠোর হয়ে আবার বলল)  চলো বাড়ি। আমরা আজ বড় হয়েছি।  তোমার ছলনা বুঝার ক্ষমতা আমাদের আছে।  

অলক কি বলবে ভেবে পেল না। হঠাৎ কেঁদে পড়ল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল-  কিন্তু তোর দিদি আমায় ক্ষমা করবে তো?  

প্রীতিশ দিদি তো আমাকে পাঠালো।  

অলক - হায়রে নারী। যাকে এত দুঃখ দিলাম, সেই আমার বিপদে আমাকে ফেরাতে চায়। আর অভিষেক?  সেও অনেক বড় হয়েছে। ভাই আগে যদি বুঝতাম। 

প্রীতিশ - যা হওয়ার হয়ে গেছে। চলো এখন বাড়ি ফিরে চলো। আমার খিদে পেয়েছে।  সারাদিন তোমায় খুজেছি।  আর পারছিনা খুব খিদে পেয়েছে। 

অলক - একটু সন্ধ্যে হোক।  না হলে পাড়ার লোক কি বলবে?  

প্রীতিশ -ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।  আর দেরি করলে রাত হবে।  


অলক আর কোন কথা বলে না। রাতে তারা ফিরে এলো। সেই রাতেই সাবান দিয়ে স্নান করে ভালো জামা কাপড় পরল।  তাও অনেকদিন পর।  অভিষেককে দেখে প্রথমে চিনতেই পারিনি। কত বড় হয়ে গেছে।  একটু আদর করতে ইচ্ছা করলেও ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে  আর কাছে গেল না।  সকালের জন্য অপেক্ষা করতে হলো তাকে। 


সকালে পাড়ার লোকেরা খবর পেয়ে অনেকে দেখতে এলো। কিন্তু অলোক লজ্জায় দোতলা থেকে নিচে এলো না। পারমিতা তো সবাইকে ওর লজ্জার কথা বলে পাঠিয়ে দিতে চাইলো।  কিন্তু পাড়ার লোকেরা সবাই পারমিতাকে ভালোবাসে। তারা বলল - যা হওয়ার হয়েছে,  ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে। আমরা একটু দেখতে পাবো না? পারমিতা তাদের অস্বীকার করতে পারল না। 

কিন্তু বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরে আসতে বলল।  


পাড়ার লোক পারমিতা কে মান্য করে, বিপদের সময় অনেক সাহায্য পায় তার কাছ থেকে।  তাই তার কথায় বিদায় নিল। সবাই চলে গেলে রুপার মা এলো পারমিতার কাছে।  পারমিতার খুব কাছের লোক সে।  ওকে নিয়ে পারমিতা উপরে গেল। 

পারমিতাকে দেখে অলোক বলল -  কি বলছিল ওরা পারু?  

পারমিতা - তোমাকে দেখতে চায়।  ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ।  তাই তোমাকে আবার সাদরে গ্রহণ করতে চায় ওরা।  

রূপার মা বলে -  ঠিক কথাই কইছ।  

অলোক -  কিন্তু আমার যে …

পারমিতা - নিজের অপকর্মের জন্য একটু তো অস্বস্তি হবেই।  

রুপার মা -  বৌঠান ওরে আর ঐসব কইয়ো না।  গ্রামে লোকে ওরে ভালোবাসে তোমারেও বাসে।  কহনোই তোমাগো হেলা করে না। 

পারমিতা - সে তো আমিও জানি। ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও। তাহলে আগের মতো তোমায় সবাই মানবে।  

রুপার মা বলে -  হ উঠান তুমি ঠিক কইছো। এমনি কি আর হক্কলে কয় বৌঠান বড় ভালা মানুষ। বুদ্ধিও কি কম আছে।  আগের কথা ভুইলা বউ ব্যাটা নিয়া সুখে থাকো দেহি দিন। 

পারমিতা  - চাকরিটা তো গেছে এখন কি করবে?  

অলোক -  তাই তো ভাবছি । 

পারমিতা-  প্রীতিশ আমাদের জমিগুলো এতদিন চাষ করেছে।  খুব ভালো ফসল হয়েছে। গত বছর বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ করছে।  ওর সঙ্গে কথা বলে চাষের কাজে মন দাও।  তুমি শুধু দেখাশোনা করতে পারলেই হবে। 

অলোক -  আমি আজই ওর সঙ্গে কথা বলব।  

পারমিতা  - চলো নিজে জল খাবার প্রস্তুত।  

অলোক - চলো মাসিমা তুমিও চলো। এতদিন তুমি যা করেছ সব পারুর মুখে শুনেছি।  

রুপার মা - ও কিছু না। কিছু না গো। চলো দেহিনি খাইয়া লও।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ